Friday, August 19, 2016

রাঙামাটি ক্রীড়ার উজ্জ্বল মুখ

একদিক দিয়ে খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বল নিয়ে যাওয়ার পথে আচমকা দিক পরিবর্তন করে বিপরীত দিকের দূরের সহযোগীকে বল ঠেলে খেলার ধারা বদলে দেওয়া ছিল তাঁর ফুটবল শৈলী ও ট্যাকটিসের এক নতুন দিক। দৌড়ের অবিশ্বাস্য গতি সম্পর্কে ধারণা করা যে কারো জন্য ছিল কঠিন। কেননা প্রাদেশিক ৪০০ মিটার দৌড়েও হয়েছিলেন তৃতীয়। তিনি রাঙামাটির গৌরব মংহ্লাচিং চৌধুরী, যাঁকে মারী নামেই চেনে পুরো বাংলাদেশ।

১৯৫২ সালে মারী যোগ দেন ফায়ার সার্ভিসে। ১৯৫৩-৫৪ সালে ওয়ান্ডারার্সে আর ১৯৫৬ সালে খেলেন মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে। পাকিস্তান জাতীয় দলে মারী জায়গা পেয়েছিলেন ১৯৫৮ টোকিও এশিয়ান গেমসে। জাপানের পত্রপত্রিকায় তাঁর খেলার প্রশংসা লেখা হলেও পাকিস্তানি ফুটবল কর্তাদের তাতে মন কাড়েনি। তাই অনিয়মিত ছিলেন মারী। পাকিস্তান জাতীয় দলে অনিয়মিত থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনিই।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মং রাজবংশের ছেলে মারী পারিবারিক সূত্রে পেয়েছিলেন রাজকীয় আচার-আচরণ, চলাফেরা ও অবাধ খরচ করার অভ্যাস। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর চেয়ে ফুটবল থেকে বেশি অর্থ উপার্জন করেছেন এমন কেউ ছিলেন না পূর্ব পাকিস্তানে। তবে দুস্থ বন্ধু বা পরিচিতদের টাকা ধার দিয়ে তা ফেরত না নেওয়ার প্রবণতার জন্য মারীকে শেষ জীবনে খেসারত দিতে হয়েছে। ইপিআইডিসিতে চাকরি সূত্রে ডিজিএমও হয়েছিলেন। কিন্তু দুহাতে খরচ করার জন্য আর্থিকভাবে থিতু হতে পারেননি। তাই জীবনের শেষ ২০-৩০ বছর পাঁচজনের সংসার টানতে দারুণ কষ্ট হয়েছে। শেষ জীবনে চিকিৎসার প্রায় আড়াই লাখ টাকা বিল দিতে না পারায় মারীকে ছাড়পত্রও দিচ্ছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ব্যবসায়ী রিয়াজউদ্দিন আল মামুন 'ফুটবলার মারী' নাম শুনে পুরো বিলটা মিটিয়ে দেন। মৃত্যুর আগের দিন তাঁকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করার পর ক্রীড়া লেখক সমিতি এক লাখ টাকা সাহায্য করেছিল। ১৯৮১ সালে মারী পেয়েছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। তাঁর নামেই রাখা হয়েছে রাঙামাটি জেলা স্টেডিয়ামের নাম।

মারীর মতো বিখ্যাত হয়তো হননি। তবে জাতীয় দলে খেলে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন বরুণ দেওয়ান। তিনি খেলেছেন আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা, ব্রাদার্সের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে। ১৯৮৮ সালে জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৬ দলে খেলে বর্ণিল ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু বরুণের। ১৯৮৯ সালে অনূর্ধ্ব ১৯,পরের বছর অনূর্ধ্ব ২৩ দলে প্রতিভার দ্যুতি দেখিয়ে ডাক পান জাতীয় দলে। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতি কাপের শিরোপাজয়ী দলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এই লেফট ব্যাক। সেখানে খেলেছিলেন ভাঙা নাক নিয়েও! ১৯৯৯ সালে ব্রাদার্সে শেষ হয় বরুণের ক্যারিয়ার। বরুণ দেওয়ান এখন দায়িত্ব পালন করছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের। তাঁর ভাই অরুণ দেওয়ানও খেলেছেন জাতীয় দলে। শুরুটা ১৯৮৬ সালের অনূর্ধ্ব ২৩ দলে। এরপর খেলেছেন ভিক্টোরিয়া, ওয়ারী, ফরাসগঞ্জ, মুক্তিযোদ্ধার মতো দলে।

তাঁদের পুরো পরিবারই ক্রীড়াঅন্তপ্রাণ। ভাইদের পাশাপাশি জাতীয় হ্যান্ডবল দলে খেলেছেন অরুণ-বরুণের দুই বোন স্বর্ণা দেওয়ান আর মিতা দেওয়ান। স্বর্ণা দেওয়ান প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাফ গেমসেও।

এ ছাড়া এফআই কামাল জাতীয় দলে খেলার পাশাপাশি অধিনায়কত্ব করেছেন আবাহনীর মতো ঐতিহ্যবাহী দলের। রাঙামাটিতে একই সময়ে দুই কামাল খেলায় তাঁকে ডাকা হতো ছোট কামাল নামে। বিপ্লব মারমা এখন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তিনিও ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় ফুটবল দলে। এ ছাড়া ফুটবলে জেলার নাম উজ্জ্বল করেছেন পরিতোষ দেওয়ান, কিংশুক চাকমা, বাথুই মারমা, নিংচাই মারমা, পান্নালালরা। মেয়েদের ফুটবলে এক সময় বাংলাদেশের সেরা তারকা ধরা হত সুইনু প্রু মারমাকে। জাতীয় মার্শাল আর্টে ভালো করেছিলেন নির্মল বড়ুয়া মিলন।

নিজের সময়ে হার্ডলসে বাংলাদেশের সেরা ছিলেন অরুণ চাকমা। জাতীয় হার্ডলসে তাঁর রেকর্ড টিকে ছিল দীর্ঘদিন। সেটা ভেঙেছেন সেনাবাহিনীর সুবেদার মোশতাক। পাশাপাশি খেলতেন ফুটবলও। খেলেছেন ফায়ার সার্ভিস, আজাদ স্পোর্টিং, ইস্পাহানির মতো ক্লাবে। অবসর নেওয়ার পর ১৯৭২ সালে অরুণ চাকমা হয়েছিলেন জাতীয় অ্যাথলেটিকস দলের কোচ। সে সুবাদে থাকতেন ঢাকাতেই। খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকায় পরিবারকে সময় দিতে পারেননি সেভাবে। এ বছরের ১৫ জুন পৃথিবীর ওপারের বাসিন্দা হয়েছেন রাঙামাটির এই কিংবদন্তি। তাঁর একটা কথা কানে বাজে এখনো, 'পাহাড়ি অঞ্চলের খেলোয়াড়দের যে স্ট্যামিনা, তাতে তারা শাসন করতে পারত দেশের অ্যাথলেটিকস। কিন্তু অযত্ন, অবহেলা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেভাবে উঠে আসেনি তারা।' তাঁর স্ত্রী মুক্তালতা চাকমা হতাশা নিয়েই জানালেন, 'তিনি দেশের জন্য অনেক সম্মাননা এনেছেন। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে অনেক দেশেই গেছেন, এনেছেন সম্মাননা। কিন্তু দেশ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে মূল্যয়ন করেনি। কোনো সম্মাননাও দেয়নি। এখন মরণোত্তর হলেও অরুণ কোনো সম্মাননা পেলে কৃতজ্ঞ থাকব আমরা।'

অরুণ চাকমার পথ ধরে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে সাফল্য পেয়েছেন এই জেলার অনেকে। তাদের অন্যতম শর্মিলা রায়, প্রীতিরানী চাকমা, স্মরণীকা চাকমা ও শাহান উদ্দিন।

হকিতে জেলার উজ্জ্বল মুখ পুস্কর খিসা মিমো। জাতীয় দলের ফরোয়ার্ড তিনি। দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সের জন্য পেয়েছেন মর্যাদার শেখ কামাল পুরস্কারও। সর্বশেষ লিগে খেলেছেন আবাহনীতে।

No comments:

Post a Comment